উপেক্ষা || কৃষ্ণা গুহ রায়
উপেক্ষা || কৃষ্ণা গুহ রায়

এইমাত্র চলে গেল অন্তরা ৷ কিছুদিন ধরেই কষ্ট পাচ্ছিল ৷ কিন্তু এত তাড়াতাড়ি... ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রণবেশ, অন্তরার স্বামী। পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই মানুষটি পেশায় ডাক্তার। নিজের অধিগত বিদ্যায় কিছুদিন ধরেই যেন অনুভব করতে পারছিলেন আর হয়তো অন্তরাকে ধরে রাখা যাবে না৷ তবে এত অপ্রত্যাশিত চলে যাওয়াটা মন থেকে মানতে পারছিলেন না প্রণবেশ। প্রতিদিনকার মতো নিজের নার্সিংহোমে গিয়েছিলেন৷ একটা জরুরি অপারেশন৷ ওটি থেকে বেরোতেই সিস্টার এগিয়ে আসেন ৷ স্যার আপনার বাড়ি থেকে অনেক বার ফোন এসেছে৷ মনে হচ্ছে কোনও জরুরি দরকার৷ বন্ধ মোবাইলের সুইচ অন করে বাড়ির নম্বরে কল করতেই কাজের মেয়ে রীতার কান্নাভেজা অস্পষ্ট স্বর শুনতে  পেলেন, দাদা শিগগির চলে আসুন। বৌদি আর নেই। মুহূর্তে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন প্রণবেশ৷ একটা অস্ফুট আর্তি গলা চিরে বেড়িয়ে আসে... অন্তরা নেই৷ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সটি বলে ওঠে, কী হয়েছে স্যার? কয়েকটা মিনিট৷ তার পরই নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিলেন প্রণবেশ৷ তিনি ডাক্তার। মৃত্যুৎতো তাঁর কাছে কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়৷ তবু বুকের মধ্যে একটা যন্ত্রণা৷ দাঁতের মধ্যে দাঁত চেপে বলে ওঠেন, তোমাদের বৌদি আর নেই।‌ আর অপেক্ষা করেননি প্রণবেশ৷ গাড়িতে বসে শুধু বলেছিলেন— তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে হবে বিজন৷ কোনও কথা বলেনি বিজন। প্রায় উড়িয়ে নিয়ে এসেছিল গাড়ি। বাড়ির গেটের সামনে গাড়ি দাঁড় করাতেই কয়েক জন এগিয়ে এলেন। সকলেই প্রণবেশের প্রতিবেশী। বয়স্ক একজন শুধু প্রণবেশের হাতটা ধরে বললেন, ভেতরে চলো৷ যন্ত্রের মতো হেঁটে চলে প্রণবেশ। দোতালার সিঁড়ি পেড়িয়ে সামনেই শোওয়ার ঘর। গোটা ঘর ভর্তি মানুষ। দমবন্ধ স্তব্ধতা  চারিদিকে। ভেতরে ঢুকতেই সমস্ত স্তব্ধতা ছিন্নভিন্ন করে ডুকরে কেঁদে ওঠে রীতা। দাদা, বৌদিকে ধরে রাখতে পারলাম না৷ রীতার মাথায় আলতো করে হাত রাখেন প্রণবেশ৷                
ধীর পায়ে খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। বিছানার ওপর ঠিক যেন ঘুমিয়ে আছে অন্তরা৷ চোখ দুটো বোজা, তবে বড় বিষন্ন-ম্লান৷ বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে৷ বিয়ের পর কুড়িটা বছর কেটে গেছে৷ শেষ কয়েকটা বছর সম্পর্কটা যেন কেমন প্রাণহীন, যান্ত্রিক হয়ে গিয়েছিল৷ অন্তরার অসুস্হতা, তার চিকিৎসক জীবনের প্রবল ব্যস্ততা, সকালে রাতে কয়েকটা কথা, সে যেন শুধু নিয়মরক্ষার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবু আজ এই মুহূর্তে অন্তরার প্রাণহীন দেহটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল, অন্তরা এই সংসারে তাঁকে শূন্য করে দিয়ে চলে গেল ৷
— ভাইদাদা, প্রণবেশের বৌদি পরমা পাশে এসে দাঁড়ায়। মনকে শক্ত করো। এখন তোমার সামনে অনেক কাজ। চাবিটা কোথায়? একটা নতুন কাপড় বার করতে হবে।
— তোষকের তলায় আছে৷ একটু তুললেই পেয়ে যাবে। দাঁড়াও আমি দিচ্ছি। পায়ের দিকটা একটু উঁচু করলেন প্রণবেশ৷ চাবি নেই৷ মাথার দিকটা উঁচু করতেই চমকে উঠলেন৷ একগোছা ওষুধের পাতা৷ একটা ওষুধও পাতা থেকে বার করা হয়নি৷ আর এটাই তো ছিল অন্তরার সব থেকে দরকারী ওষুধ। তা হলে কি এত দিন ধরে অন্তরার জন্য যে ওষুধ তিনি রেখে যেতেন, তার একটাও সে খায়নি! কিন্তু কেন সে এ রকম করল? কিসের অভিমান ছিল তাঁর? কেন স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে ঠেলে দিল নিজেকে?
--- চাবি পেয়েছ? জিজ্ঞাসা করে পরমা বৌদি. চাবির গোছাটা তার দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে দিলেন প্রণবেশ। দরজার সামনে এসে কেউ ডাক দিল, বাইরে এসো প্রণবেশ, দরকার আছে৷ প্রণবেশ পরমা বৌদির দিকে ফিরে বললেন, আমি বাইরে আছি। দরকার হলে আমায় ডেকো। বারান্দায় পেতে রাখা একটা চেয়ারে বসলেন প্রণবেশ। মানুষ জন আসছে৷ সকলেই সমবেদনা জানাচ্ছে৷ একটা ঘোরের মধ্যে স্থির হয়ে আছেন প্রণবেশ৷ এক সময় পরমা বৌদি এসে দাঁড়ায়— ভেতরে চলো ঠাকুরপো। অন্তরাকে সাজিয়েছি। একবার দেখে নাও।                    
লাল বেনারসী পরা। কপালে চন্দনের টিপ।  সিঁথিতে সিঁদুরের গাঢ় প্রলেপ লাগানো। লাল আলতা পরা পা৷ ঠিক যেন বিয়ের সাজে সেজে আছে। আর দেখতে পারেন না প্রণবেশ৷ দু'হাতে মুখ ঢেকে প্রায় ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। অনেক‌ দিন আগের একটি ঘটনা মনে পড়ে যায়। বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় অন্তরা জানতে পারে সে সন্তান ধারণে‌অক্ষম। সেই যন্ত্রণা ভোলবার জন্যই সংসারের হাজার কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখত। দু-একবার বাচ্চা  অ্যাডপ্ট করার কথাও বলেছিল। প্রণবেশের সায় ছিল না। এক গাছের ছাল কখনও আর এক গাছে জোড়া লাগে না। পরে আর কখনও এই ব্যাপারে কথা তোলেনি অন্তরা। প্রণবেশেরও পশার বাড়ছিল। সার্জারিতে যত নামডাক হচ্ছিল, ততই বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাচ্ছিল। অন্তরা তার জন্য জেগে বসে থাকত৷ একদিন খেতে খেতে বলেছিল, এত রাত কোরো না, আমার বড় একা লাগে। খুব গম্ভীর ভাবে প্রণবেশ উত্তর দিয়েছিল, তুমি রোজ রোজ এ ভাবে আমার জন্য বসে থেকো না। আমার কাজ শেষ করে ফিরতে রোজই রাত হবে।
আর কোনও‌ দিনই কিছু বলেনি অন্তরা। একটা কাজের প্রাচীর প্রণবেশকে অন্তরার থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছিল৷ শুধু রাতের বেলায় কখনও কখনও দেহ যন্ত্রের ক্ষুধা মেটানোর জন্য অন্তরার কাছে যেতেন প্রণবেশ৷ সেই আদিম প্রবৃত্তিতে অন্তরার মনের ক্ষতকে কতটা প্রলেপ দিত, সেটা প্রণবেশ জানার কোনও প্রয়োজন মনে করতেন না। 
কারও ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন প্রণবেশ। খুড়তুতো ভাই বাবলু সামনে দাঁড়িয়ে।
— ফোন করেছিলাম। গাড়ি এসে গেছে। তুমি কি কিছু বলবে ছোড়দা?
মাথা নাড়লেন প্রণবেশ৷ তোরা যা ভাল মনে করবি কর। আলমারিতে টাকা রাখা আছে। পরমা বৌদিকে বল, বার করে দেবে৷
— টাকার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না৷ আমরা সব ব্যবস্হা করে ফেলেছি।
— সবাইকে কি খবর দেওয়া হয়েছে?
— হ্যাঁ ছোড়দা, বৌদির দাদাকে আমেরিকায় ফোন করেছিলাম৷ তিনি বললেন, তোমরা আমার জন্য ওয়েট কোরো না৷ আমি‌ তো এত তাড়াতাড়ি যেতে পারব না।
— ঠিকই বলেছেন ৷ তা ছাড়া সকলেই নিজের কাজে ব্যস্ত ৷ তা হলে আর দেরি করে কী হবে? এ বার ওকে নিয়ে চলো ওর শেষ ঠিকানায়।
ফুলে ঢাকা অন্তরাকে নিয়ে আসে সবাই৷ কাচের গাড়ি। ও পারের যাত্রা পথের রথ। পেছনে এক সার গাড়ি। প্রণবেশের অনেক ডাক্তার বন্ধুরাও এসেছেন৷ এই একটা মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সকলের যেন কয়েক ঘণ্টার অবসর।
শ্মশানে গাড়ি পৌঁছায়। একটা ফাঁকা চাতালে ফুলে ফুলে ঢাকা অন্তরার নিথর দেহটাকে শুইয়ে রাখা হয়। আগে আরও দুটো বয়স্ক মানুষের দেহ৷ চার পাশে বসে থাকা মানুষগুলোর চোখেমুখে বিষন্নতার ছাপ।
একধারে চুপ করে বসে ভাবেন প্রণবেশ। সকলকেই একদিন এখানে আসতে হবে। জীবন পাড়ানির শেষ হিসেবের পাতা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে ওই আগুনে।‌ শুধু পড়ে থাকবে কিছু স্মৃতি৷ যদি সবই শেষ হয়ে যাবে তবে কোন উচ্চাশার পেছনে এত দিন ধরে ছুটে চলেছেন? সেই উচ্চাশা তাঁকে অর্থ ছাড়া আর কোন প্রাপ্তির ঝুলি ভরিয়ে দিল!নিজের মধ্যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ান, কিন্তু কোনও উত্তরই মেলে না।
সময়ের ঘড়িটা এগিয়ে চলে। দিন, সপ্তাহ৷ অন্তরার পারলৌকিক কাজ সব শেষ হয়৷ কোনও কৃপণতা করেননি প্রণবেশ৷ সকলেই খুশি৷ প্রণবেশের মধ্যেও একটা তৃপ্তি। ভাল ভাবেই অন্তরার কাজটুকু করতে পেরেছেন।‌ একে একে সকলে চলে যায়৷ ফাঁকা ঘর৷ দিন গড়ায়৷ এখন আর শোকে সান্তনা দেবার জন্য কেউ আসে না। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। ধীরে ধীরে নিজেকেও সামলে নেন প্রণবেশ। নিয়মের শক্ত বাঁধন তাঁকে প্রতিদিনকার দিনপঞ্জী পালন করতে শিখিয়েছে৷
সে দিন নার্সিংহোম থেকে বার হতে একটু রাত হয়ে গিয়েছিল৷ পেছনের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে ছিলেন প্রণবেশ৷ গাড়ি চালাচ্ছিল বিজন৷ ভাল ছেলে৷ পাঁচ বছরে গভীর একটা বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
বাইপাশের রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছিল৷ আলোর রেখা ছড়িয়ে দু'ধারে শুধু গাড়ি ছুটে চলেছে৷ আচমকা প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়িটা থেমে গেল। 
প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন প্রণবেশ— কী হল বিজন?  — আমি দেখছি দাদা। মনে হচ্ছে ইঞ্জিনে কোনও গন্ডগোল।
— সে কী? তুমি কিছু দেখোনি? 
— হ্যাঁ, এই তো পনেরো দিন আগে গাড়ি চেক করালাম। সব ঠিক ছিল৷ সকালে যাওয়ার সময়েও কোনও অসুবিধা হয়নি।
— তা হলে এখন কী করবে? এখানে কোনও ট্যাক্সিও পাওয়া যাবে না।‌ এত রাত...
চুপ করে কিছু ভাবে বিজন৷ তার পর বলে, সামনে মিনিট কয়েক গেলেই আমাদের পাড়া৷ রাস্তা থেকে একটু ভেতরে যেতে হবে৷ ওখানে মন্টুদার গ্যারেজ। আমি একটু দেখে নিই। যদি ঠিক না হয় মন্টুদাকে একটা ফোন করে দিলেই চলে আসবে। গাড়ির বনেট খোলে বিজন। ভেতরে চুপ করে বসে থাকেন প্রণবেশ। একটু পরেই সামনে আসে বিজন।
— হবে না স্যার।‌ আমি মন্টুদাকে ফোন করে দিচ্ছি৷
কিছুক্ষণের মধ্যেই মোটর সাইকেলে চেপে দু'জনে উপস্থিত হয়।‌ৎমাঝবয়সী মন্টুদা একপলক বিজনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে— কোনও চিন্তা নেই, দেখছি।
গাড়ি থেকে নেমে আসেন প্রণবেশ৷ চুপ করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। নিচু হয়ে ইঞ্জিন পরীক্ষা করছিল মন্টুদা। মুখ তুলে বলল, একটু সময় লাগবে স্যার। একটা প্লাগ পুড়ে গেছে।
— মোটামুটি কতটা সময় লাগতে পারে?
— ধরে রাখুন আধ ঘন্টা থেকে চল্লিশ মিনিট৷
ঘড়ির দিকে তাকালেন প্রণবেশ৷ দশটা দশ। তার মানে অন্তত এগারোটা৷ ততক্ষণ এই ভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে!
বিজন এগিয়ে এসে বলে, একটা কথা বলব স্যার, কাছেই আমাদের বাড়ি। এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে বরং আমাদের বাড়িতে একটু বসবেন চলুন।
কাজ করতে করতে মন্টুদা বলে— বিজন ঠিকই বলেছে স্যার, আপনি যান৷ ঠিক হয়ে গেলে আমি গাড়ি নিয়ে ওখানে আসছি।
সঙ্কুচিত হয়ে ওঠেন প্রণবেশ। বলেন, এত রাতে তোমার বাড়ি যাব? বাড়ির লোকের অসুবিধে হবে৷
— না স্যার, আমার বউ ঝর্ণা আপনাকে দেখলে খুব খুশিই হবে৷ চলুন স্যার, চলুন৷
বিজনের আন্তরিকতা প্রণবেশের মনকে নাড়া দেয়৷ গাড়ি থেকে ব্যাগটা বের করে বললেন— চলো।
একটু এগোতেই বাড়িঘর চোখে পড়ল। বেশির ভাগই ইটের দেওয়াল। টিনের চালা। পাড়ার শেষ প্রান্তে বিজনের ঘর। দরমার দেওয়াল। টালির ছাউনি। সামনে বারান্দা। বাইরে থেকে বিজন ডাক দেয়, ঝর্ণা তাড়াতাড়ি বাইরে এসো, দেখো স্যার এসেছেন।
বিজনের ডাকে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় ঝর্ণা।  ছোটখাটো চেহরা। পরনে সাধারন শাড়ি। একপলক প্রণবেশের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয়। তার মতো একজন মানুষ এত রাতে এই ঘরে আসবে এটা বোধহয় ভাবতে পারেনি। কয়েক মুহূর্ত পরেই প্রায় ছুটে এসে প্রণাম করে বলে ওঠে— আসুন দাদা, ভেতরে আসুন।‌ আপনি যে আমাদের বাড়িতে কোনও দিন আসবেন, তা আমি ভাবতেও পারিনি। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে!
ঝর্ণার আন্তরিক ব্যবহার প্রণবেশের খুব ভাল লাগে। প্রণবেশ ভেতরে ঢোকেন।‌ ছোট্ট অথচ সাজানো-গোছনো ঘর। একটা শ্রী আছে।
একটা চেয়ার এগিয়ে দেয় ঝর্ণা— বসুন দাদা, আমি আসছি। বাঁধা দেন প্রণবেশ।
— কোথাও যেতে হবে না। এখানে বসো। তোমাদের সঙ্গে একটু কথা বলি।
ছেলেমানুষের মতো কথা বলে ঝর্ণা৷ হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যায়। মুখ তুলে বলে, স্যার পায়েস করেছি। আপনাকে একটু দিই?
— দাও। তবে অল্প করে।
পায়েসের বাটিটা হাতে নিয়ে হঠাৎ করে অন্তরার কথা মনে পড়ে যায় প্রণবেশের। তাঁর জন্মদিনে প্রত্যেক্যবার নিজের হাতে পায়েস করে খাওয়াতো৷ পরে সব যেন কেমন ওলটপালট হয়ে গেল।
বাইরে মন্টুর গলা পাওয়া গেল৷ গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে৷ পায়েসটা শেষ করে ঝর্ণার দিকে চেয়ে প্রণবেশ বললেন, ছুটির দিন দেখে আমার ওখানে যেও। খাওয়াদাওয়া করে ফিরবে৷
বিজন বলল, চলুন দাদা।
প্রণবেশ বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই পেছনে বিজনের গলার আওয়াজ পেলেন।
— তুমি খেয়ে নিও ঝর্ণা। দাদাকে পৌঁছে দিয়ে আমার ফিরতে একটু দেরি হবে। চিন্তা কোরো না। বারান্দার লাইটটা একটু জ্বালিয়ে রেখো। ও ভাল কথা, ওষুধগুলো খেয়েছ তো?
— হ্যাঁ খেয়েছি।
— আমি কিন্তু এসে দেখব৷ সে দিন কিন্তু তুমি ওষুধ খাওনি।
— সে দিন আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আর হবে না।
আর শুনতে পারলেন না প্রণবেশ৷ ধীর পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। মনে পড়ল, মাস তিনেক আগে বিজন বলেছিল যে, ওর বৌয়ের শরীরটা ভাল না।‌ সব্য সময় খালি দূর্বল লাগে৷ প্রণবেশ ব্লাড টেস্ট করতে দিয়েছিল। রিপোর্টে এনিমিয়া ধরা পড়েছিল৷ প্রণবেশ তখন ওষুধ লিখে দিয়েছিল আর বলেছিল, ওষুধগুলো ঠিক‌ মতন খেতে বলবে। ঠিকঠাক না খেলে কিন্তু এর পরে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ব্লাড দিতে হবে।

বাড়ি ফিরে খাওয়া শেষ করে বারান্দায় এসে বসলেন প্রণবেশ। অমাবশ্যার রাত। আকাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে কোথাও একটা রাতজাগা পাখি একটানা ডেকে চলেছে। চুপ করে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হল, তিন মাস হল অন্তরা ওই দূর আকাশে মিলিয়ে গেছে৷ তার ওপর চাপিয়ে দিয়ে গেছে একটা অপরাধের বোঝা৷ আজ বিজনকে দেখে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে।
নিজেই নিজেকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন। নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, সে কি কখনও অন্তরার কাছে জানতে চেয়েছে, ও ভাল আছে কিনা! কখনও জানতে চেয়েছে ওষুধগুলো ঠিক মতন খেয়েছে কি না! অন্তরার কোনও পছন্দের প্রতিই তো তাঁর কোনও আগ্রহ ছিল না।
অথচ অন্তরা নিঃশব্দে তাঁর পছন্দের সব কিছুকেই সযত্নে সাজিয়ে রেখে গেছে। নিজের অধিকার বা
কৈফিয়তের সুর নিয়ে কখনও কথা বলেনি।
শোওয়ার ঘরে দেওয়ালে টাঙানো অন্তরার ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন প্রণবেশ। চোখ দুটো ভিজে এল। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন— আজ আমি বুঝেছি অন্তরা, কিসের জন্য তুমি তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে নিজেকে ঠেলে দিয়েছিলে! এত অভিমান তোমার! তুমি তো ভুল কিছু চাওনি৷ চেয়েছিলে তোমার প্রতি একটু সময়৷ সেটাও আমি তোমায় দিয়ে উঠতে পারিনি অন্তরা।
আর কিছু বলতে পারলেন না। এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল৷
মনের মধ্যে তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে এক আত্মপোলব্ধির চেতনা জেগে উঠল৷ এত দিন তিনি অসুস্হ মানুষের হৃদয় কাঁটাছেঁড়া করে সুস্থ করে তুলেছেন৷ কিন্তু আজ বিবেকের যে গ্লানি আর অনুশোচনার চোরাস্রোত তাঁর সমস্ত হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে তুলছে, তাকে সুস্হ করার চিকিৎসা তাঁর জানা নেই ৷

সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান